বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান এম শাহ আলম চায়ের উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমকালের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ আবদুল্লাহ
সমকাল : করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করছেন আপনারা। চা শিল্পে এর প্রভাব কতটা।
এম শাহ আলম : করোনা মহামারি শুরু হলে চা উৎপাদন চালু রাখা চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়। চা শ্রমিকরা স্বাভাবিক সময়েও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করেন। এ বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী উৎপাদন অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। ফলে উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়েনি। যদিও করোনায় চাহিদা কমে যায় ৬০ শতাংশ। এতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ চা অবিক্রীত রয়েছে। গড় উৎপাদন খরচের চেয়ে নিলামে দাম কেজিতে ৩০ টাকা কমে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর চায়ের কেজিপ্রতি গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২০০ টাকা। কম দাম, বিপুল অবিক্রীত চা ও ব্যাংকের অর্থায়ন না থাকায় মূলধনের অভাবে পড়েছে অধিকাংশ কোম্পানি। অবিক্রীত চা গুদামজাত করতেও গুণতে হচ্ছে বিপুল অর্থ। এতে চায়ের গুণগত মান রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
সমকাল : দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে। আবার আমদানিও হচ্ছে। তাহলে কি চাহিদা বাড়ছে বেশি?
এম শাহ আলম : হ্যাঁ, কয়েক বছর ধরে উৎপাদন বেড়েই চলেছে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী চা আমদানি এবং সুযোগমতো রপ্তানিও হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত উৎপাদন বেড়েছে ৩০২ শতাংশ। অন্যদিকে ভোগ বেড়েছে আরও বেশি।
সমকাল : উৎপাদন বাড়ানোর কী উদ্যোগ নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কী?
এম শাহ আলম : নতুন উৎপাদন কৌশল, অধিক ফলনশীল চারা রোপণ, সেচ সুবিধা বাড়ানো, অলাভজনক গাছ পুনঃরোপণ এবং কারখানা আধুনিকীকরণের ফলে চা উৎপাদন বাড়ছে। প্রতিবছর বাধ্যতামূলক সম্প্রসারণের আওতায় আড়াই শতাংশ হারে আবাদ বাড়ানোর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সরকারের দেওয়া ভর্তুকি মূল্যে সার এবং ওএমএসের মাধ্যমে চাল বা গম সরবরাহ উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করছে। করোনা মোকাবিলায় ৯ শতাংশ সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের যে ঘোষণা করেছে, তা ছাড় হলে চা উৎপাদন আরও ৯০ লাখ কেজি বাড়বে। তা ছাড়া বাগানগুলোতে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার হেক্টর জমি পুরাতন ও অলাভজনক গাছ রয়েছে। এগুলোকে নতুন করে আবাদের আওতায় আনতে সরকারের সহায়তা দরকার; কমপক্ষে লাগবে ৩৬০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া আগামী ১৫ বছরে শ্রমিকদের জন্য ১৫ হাজার ঘর বা বাড়ি বানাতে ২ শতাংশ সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দরকার। বাগান মালিকদের একার পক্ষে এতটা ব্যয় করা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি চা বোর্ডের বাস্তবায়নাধীন 'উন্নয়নের পথনকশা বাংলাদেশ চা শিল্প' প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ২০২৫ সালে উৎপাদন বেড়ে ১৪ কোটি কেজি হবে।
সমকাল : অব্যবহূত জমি আবাদের আওতায় আনা যাচ্ছে না কেন?
এম শাহ আলম : অধিকাংশ চা বাগান টিলা ও পাহাড়বেষ্টিত। চা নীতি অনুযায়ী, চা চাষের জন্য উপযুক্ত ভূমি মোট এলাকার প্রায় ৫০ শতাংশ। চাষযোগ্য প্রায় সব জমি ইতোমধ্যে চাষের আওতায় এসেছে। অবশিষ্ট জমি লেবার লাইন, কারখানা, রাস্তা, ধানের জমি, জলাধার, খেলার মাঠ প্রভৃতি কাজে ব্যবহূত হয়। এ ছাড়া অব্যবহূত জমি সরকার ঘোষিত বার্ষিক আড়াই শতাংশ হারে বাধ্যতামূলক সম্প্রসারণ শর্তের কারণে আবাদযোগ্য জমি বেড়েছে।
সমকাল : চা শ্রমিকদের অসন্তোষের খবর প্রায়ই শোনা যায়। তাদের জীবনমান উন্নয়নে করণীয় কী?
এম শাহ আলম : কথাটি সর্বাংশে সঠিক নয়। চা শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে প্যাকেজ চালু রয়েছে, যা নগদ এবং সেবা ও দ্রব্যাদির মাধ্যমে দেওয়া হয়। যেমন তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাগান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নগদ মজুরি ছাড়াও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দেয়। প্রতি শ্রমিককে দুই টাকা কেজি ভর্তুকি মূল্যে পরিবারের তিনজন পোষ্যসহ রেশন (চাল/আটা) দেওয়া হয়। বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। বিনা ভাড়ায় বাসস্থান, পয়ঃনিস্কাশন সুবিধা ও শৌচাগার এবং বাগান মালিকদের খরচে বিশুদ্ধ পানীয় জল ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। বিনামূল্যে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাবৃত্তি, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের আজীবন পেনশন ও বাসস্থান, মৃত ও অবসরপ্রাপ্ত পোষ্যদের চাকরি দেওয়া হয়।
সমকাল : চায়ের মান নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন তোলেন ভোক্তারা। মান রক্ষায় আপনার পরামর্শ কী?
এম শাহ আলম : গুণগত মানের দিক থেকে দেশে উৎপাদিত চা বিশ্বমানের। বাংলাদেশ চা বোর্ড থেকে ব্র্যান্ড নিবন্ধন দেওয়া হয় এবং বিএসটিআই মান নিয়ন্ত্রণ করে। তবে দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ক্যাটাগরির চায়ের সঙ্গে চোরাই পথে আসা নিম্নমানের চা মিশিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চা বাজারজাত করে। এতেই মূলত গুণগত মান নষ্ট হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাঠ ও কারখানায় আমরা ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করায় গুণগত মান উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বর্তমানে গুণগত মানের দিক থেকে ভারতের কাছার ও দোয়ার্সের চায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের চায়ের তেমন পার্থক্য নেই। তবে বর্ডার হাট ও চোরাই পথে আসা নিম্নমানের চা বন্ধ করতে হবে।
সমকাল : সমতলে চাষ সম্প্রসারণে সরকার কাজ করছে। এর সম্ভাবনা কতটা।
এম শাহ আলম : উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটের সমতল ভূমিতে সাফল্যজনকভাবে চা চাষ হচ্ছে, যার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে। উন্নত জাতের চাষ ও চাষপ্রণালি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হলে এ কার্যক্রম আরও সফল হবে।
সমকাল : সীমান্ত হাটে চায়ের বেচাকেনা বন্ধের প্রস্তাবের বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
এম শাহ আলম : ইদানিং ভারতের সঙ্গে সীমান্ত হাটে বিনা শুল্ক্কে কেনাবেচার সুবিধা নিয়ে কিছু মুনাফালোভী অবাধে কম মূল্যের নিম্নমানের চা আনছে। সীমান্ত সংলগ্ন বাজারগুলোতে চোরাই পথে আসা চাও অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এতে উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই সীমান্ত হাটের মাধ্যমে বিনা শুল্ক্কে অবাধে নিম্নমানের চা আসা বন্ধ করতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
সমকাল : চা শিল্পের সম্ভাবনা এবং তা অর্জনে করণীয় বিষয়ে জানতে চাই।
এম শাহ আলম : চা শিল্পের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। এজন্য বেশ কিছু কাজ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে অধিক ফলনশীল ক্লোন চারা ও উন্নত বীজ উদ্ভাবন, আবাদযোগ্য ভূমিকে উৎপাদনে আনা, অলাভজনক গাছ পুনঃরোপণ, কারখানা আধুনিকীকরণ, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, কৃষি ব্যাংক ছাড়া অন্যান্য ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা, যোগাযোগ, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পরিবহন সুবিধা বাড়ানো, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বিদেশে বাজার সম্প্রসারণ ও নতুন বাজার সৃষ্টি এবং রপ্তানিতে প্রণোদনা দেওয়া।
সমকাল : এ খাতে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণে করণীয় কী?
এম শাহ আলম : চায়ের ভালো দাম পাওয়া গেলে ও লাভজনক হলে বিনিয়োগের সম্ভাবনা বাড়বে। কেননা দেশে গুণগত মানের চা উৎপাদনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এ জন্য সবার আগে চোরাই পথে নিম্নমানের চা আসা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ চা বোর্ড ও সরকারের বিনিয়োগবান্ধব সহায়তা কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগকে ত্বরান্বিত করবে। এসব পদক্ষেপ চা শিল্পকে টেকসই রূপ দিতে ভূমিকা রাখবে।